ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে এই অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হওয়ার ১০০ দিন পর ১২ নভেম্বর, ২০১৯-এ কাশ্মীরি সাংবাদিকরা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করছেন। সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা ইন্টারনেট বন্ধের সময় কাজ করতে বাধাগ্রস্থ হয়, যার আদেশ প্রায়শই অস্থিরতা বা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেওয়া হয়। (এপি ছবি/মুখতার খান)

ডিজিটাল নিরাপত্তা: ইন্টারনেট শাটডাউন

সিপিজে (কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস) এর গবেষণা মতে, ইন্টারনেট শাটডাউন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর গুরুতর প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে সাংবাদিকদের কার্যকরভাবে কাজ করতে নানা বেগ পেতে হয়। ইন্টারনেট বন্ধ বা অ্যাক্সেস সীমিত করার অর্থ হল কোন একটি ঘটনা ঘটার পরে সংবাদকর্মীরা সোর্সের সাথে যোগাযোগ করতে, তথ্য যাচাই করতে বা তা লিপিবদ্ধ করতে বাধাগ্রস্থ হন। আর্ন্তজাতিক সংস্থা অ্যাক্সেস নাও-এর মতে, শাটডাউন সাধারণত সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নির্বাচনের সময় ঘটে এবং এটি সরকারের তথ্য নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি।

ইন্টারনেট শাটডাউন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে: পুরো দেশে বা নির্দিষ্ট এলাকায়। সম্পূর্ণ শাটডাউনের সময় সাংবাদিকেরা ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা একেবারেই ব্যবহার করতে পারেন না, যার অর্থ তারা ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে বা ল্যান্ডলাইন বা সেল ফোনের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। আংশিক শাটডাউনের ক্ষেত্রে সরকার নির্দিষ্ট কিছু সাইট বা পরিষেবা, যেমন যোগাযোগের অ্যাপ বা ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্লক করতে পারে। এছাড়াও, সরকার ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিতে পারে, যা ইন্টারনেট কার্যত অকেজো করে দেয়। কারণ এসময় কোনো ওয়েবপেজ লোড করা যায় না বা কোনো কন্টেন্ট আপলোড করা যায় না।

এমন বিভিন্ন ধরনের শাটডাউনের সময় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভালো প্রস্তুতি থাকা জরুরি। নিচের তথ্যগুলো ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় সাংবাদিকদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

সাধারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা

শাটডাউনের আগে ভালো ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এতে আপনি আরও ভালোভাবে প্রস্তুত এবং সুরক্ষিত থাকবেন।

  • আপনার ডিভাইসগুলো সুরক্ষিত রাখুন এবং সেগুলিতে যতটা কম সম্ভব তথ্য সংরক্ষন করুন। যদি শাটডাউন চলাকালীন আপনি আটক হন, তাহলে আপনার এবং আপনার সোর্সের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
  • অন্যদের সাথে যোগাযোগের জন্য এন্ড টু-এন্ড এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করুন, যেমন সিগনাল বা হোয়াটসঅ্যাপ। এগুলোতে বার্তা এনক্রিপ্ট করা থাকে এবং প্রেরক ও প্রাপক ছাড়া কেউ এটি দেখতে পায় না।

ডিভাইস সুরক্ষা এবং এনক্রিপ্টেড যোগাযোগ সম্পর্কে আরও জানুন সিপিজে ডিজিটাল সুরক্ষা কিট-এ।

ইন্টারনেট শাটডাউনের জন্য প্রস্তুতি

  • ইন্টারনেট বা যোগাযোগ ব্যবস্থার শাটডাউন কখন ঘটবে তা আগে থেকেই অনুমান করুন। সাধারণত নাগরিক অস্থিরতা, বিক্ষোভ এবং নির্বাচনের সময় এই ধরনের শাটডাউন ঘটে। কিছু অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা দেখা যেতে পারে।
  • ইন্টারনেট এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার জন্য সরকারের আইন পরিবর্তনের দিকে নজর রাখুন। আশেপাশের দেশগুলির সরকার কী করছে সে সম্পর্কে খোঁজ রাখুন।
  • সম্পূর্ণ শাটডাউনের সময় কেমন প্রস্তুতি নেওয়া হবে– তা নিয়ে আপনার নিউজরুম ও সহকর্মীদের সঙ্গে পরিকল্পনা করুন। ইন্টারনেট ছাড়া তথ্য সংগ্রহ ও প্রেরণ করার পদ্ধতি নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করুন। ল্যান্ডলাইন ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারেন, তবে সংবেদনশীল কথোপকথনের জন্য এটি নিরাপদ নয়। শাটডাউনের মুখে পড়তে পারে– এমন অঞ্চলে থাকা সহকর্মীদের কীভাবে সমর্থন জোগাবেন– তা নিয়ে পরিকল্পনা করুন।
  • শাটডাউনের আগে অনলাইন থেকে প্রয়োজনীয় নথি ও সামগ্রী প্রিন্ট করে রাখুন।
  • কর্মীদের ইউএসবি ড্রাইভ বা সিডি প্রদান করুন যাতে শাটডাউনের সময় ডেটা সংরক্ষণ করা যায়।

সঠিক টুল নির্বাচন করুন

অনলাইন টুল এবং পরিষেবাগুলো নানান ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। সাংবাদিকদের সর্বশেষ ডিজিটাল সুরক্ষা তথ্য সম্পর্কে আপ টু ডেট থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বিশেষত মেসেজিং অ্যাপের ক্ষেত্রে।

  • আংশিক শাটডাউনের সময় ব্লক করা সাইটগুলোতে অ্যাক্সেস পেতে ভিপিএন পরিষেবাগুলো ডাউনলোড ও সেট আপ করুন। ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীরা প্রায়ই ভিপিএন ব্লক করে, তাই বেশ কয়েকটি বিকল্প রাখা ভালো, যেন একটি কাজ না করলে অন্যটি ব্যবহার করে আপনি সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। ভিপিএন সম্পূর্ণ ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় কার্যকর নয়।
  • বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের অ্যাপ ডাউনলোড ও সেট আপ করে রাখুন। যেন একটি পরিষেবা ব্লক হয়ে গেলে অন্যটি ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন অ্যাপের নিরাপত্তা দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন সমর্থন করে এমন অ্যাপকে প্রাধান্য দিন। ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় আপনি এসএমএসের মতো অনিরাপদ উপায়ে যোগাযোগে বাধ্য হতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংবেদনশীল তথ্য শেয়ারের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
  • ব্লুটুথ, ওয়াইফাই ডিরেক্ট, এবং নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি) ব্যবহার করে কীভাবে ডেটা শেয়ার করবেন তা শিখুন। এই পদ্ধতিগুলো ইন্টারনেট ছাড়াই ডেটা ট্রান্সফার করতে সাহায্য করে। এগুলি আপনার ফোনের সেটিংসে পাওয়া যাবে। শাটডাউনের আগে এগুলি ব্যবহার করে অনুশীলন করুন।
  • পিয়ার-টু-পিয়ার মেসেজিং টুল, যেমন ব্রায়ার (Briar) বা ব্রিজিফাই (Bridgefy) ডাউনলোড ও সেট আপ করুন। ব্রায়ার এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ যা ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ডিরেক্ট (WiFi Direct) এবং ব্লুটুথ এর মাধ্যমে কাজ করে। ব্রিজিফাই দীর্ঘ দূরত্বে কাজ করে এবং আইফোনে ব্যবহার করা যায়।
  • শাটডাউনের সময় রোমিং বা স্যাটেলাইট ফোনসহ একটি আন্তর্জাতিক সিম কার্ড ব্যবহার করে আপনি ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করতে পারেন।

ইন্টারনেট শাটডাউনের সময়

  • ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় রিপোর্টিং করতে গিয়ে আপনি আটক হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। নিশ্চিত করুন যে, আপনার ডিভাইসে যেন এমন কোনো সংবেদনশীল তথ্য না থাকে, যা আপনাকে বা অন্যদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
  • তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট করার কাজটি কঠিন হলেও, আপনি চারপাশের ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করতে পারেন। ইউএসবি বা সিডি ব্যবহার করে ডেটা সংরক্ষণ করুন এবং সহকর্মীদের কাছে হস্তান্তর করুন। সম্ভব হলে ডেটাগুলো এনক্রিপ্ট করুন। কারণ আপনি আটক হলে এবং এসব ডিভাইসে থাকা তথ্যগুলো এনক্রিপ্ট করা না হলে সেগুলো কর্তৃপক্ষ দেখতে পারবে। 
  • ব্লুটুথ, ওয়াইফাই ডিরেক্ট বা এনএফসি ব্যবহার করে ডিভাইসের মধ্যে ফাইল শেয়ার করুন। মাথায় রাখুন যে, এভাবে ডেটা প্রেরণ করা নিরাপদ নয়, এবং কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই এগুলো বন্ধ করুন, যেন আশেপাশে থাকা অন্য অজানা ডিভাইসের সঙ্গে এটি সংযুক্ত না হয়।
  • ব্রায়ার ও ব্রিজিফাই-এর মতো পিয়ার-টু-পিয়ার কমিউনিকেশন অ্যাপ ব্যবহার করুন। প্রতিটি অ্যাপের নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকুন।
  • শাটডাউনের সময় সংবেদনশীল তথ্য শেয়ারের জন্য এসএমএস বা ফোন কল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলো আটকানো বা অ্যাক্সেস করা যেতে পারে।
  • অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই অ্যাপ ডাউনলোড করতে এফ-ড্রয়েড (F-Droid) ব্যবহার করতে পারেন। অ্যান্ড্রয়েডের ক্ষেত্রে আরেকটি বিকল্প হলো এপিকে (APK) ফাইল ব্যবহার করে অ্যাপ ইনস্টল করা। এই অ্যাপ ফাইলগুলো ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই ডিভাইসের মধ্যে শেয়ার করা যেতে পারে, তবে এগুলো অ্যাপ স্টোরের যাচাই প্রক্রিয়ার  আওতায় পড়ে না, তাই শুধুমাত্র বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ফাইল গ্রহণ করুন।
  • শাটডাউনের প্রমাণ রাখার জন্য ব্লক করা সাইটগুলোর স্ক্রিনশট নিন। পরে এই তথ্যগুলো আপনার দেশের বা আন্তর্জাতিক ডিজিটাল অধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

ইন্টারনেট শাটডাউনের পর

  •  ইন্টারনেট শাটডাউনের জন্য প্রস্তুতির সময় কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে এবং কোনগুলো করেনি— তা নিয়ে আপনার নিউজরুম বা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করুন।
  • আপনার ডিভাইস পর্যালোচনা করুন, ব্যাকআপ নিন এবং ডেটা সুরক্ষিত রাখতে এনক্রিপ্ট করুন।

অন্যান্য রিসোর্স